ধলাই সিলেটের সীমান্তবর্তী একটি নদ। এর উৎসমুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সাদা পাথর। সবুজ পাহাড়, মেঘের হাতছানি আর বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পাথর নদের বুকে মিলেমিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ। তবে পাথর লুটপাটের কারণে আজ বিবর্ণ প্রকৃতির এ লীলাভূমি।
গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছিল সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর ও জাফলংয়ের পাথর লুট। এ অবস্থায় হুমকির মুখে পড়েছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র দুটি।
স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে লুটপাট চলছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। প্রতিদিন কোটি টাকার পাথর লুট হচ্ছে সিলেটের এ দুই পর্যটন এলাকা থেকে। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে থানায়।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও কার্যত পর্যটন কেন্দ্রগুলো এখনো অরক্ষিত। এর পেছনে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের পর্যটকদের কাছে পরিচিত সাদাপাথর ও জাফলং পর্যটন কেন্দ্র বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমি সন্তান বাংলাদেশের সংগঠক শুয়াইবুল ইসলাম বলেন, জাফলং কিংবা সাদাপাথর বলেন, সংঘবদ্ধ চক্র সমানতালে লুটপাট করছে। প্রশাসন কঠোর হলে এ লুটপাট ঠেকানো যেত। প্রকৃতিকে কীভাবে গিলে খাচ্ছে অসাধু চক্র, তা দেখতে চাইলে সাদাপাথর ঘুরে আসা যায়। আমরা মনে করি প্রশাসন কঠোর না হলে যতই চিৎকার করি কেন, কোনো কাজে আসবে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধলাই নদের তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। যা দিয়ে ৫০ বছর চালানো যাবে এ হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়ে সোয়া ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। ব্রিটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্লান্ট। মাঝখানে রয়েছে চারটি সাবস্টেশন। দুই প্রান্তে ডিজেলচালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউজ, ভোলাগঞ্জ রেলওয়ে কলোনি, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউজও নির্মাণ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্লান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সেই থেকে অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল ভোলাগঞ্জ রোপওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা।
একসময় ভোলাগঞ্জ এলাকাটি দেখতে অনেকটা বদ্বীপের মতো ছিল। ধলাই নদ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদের সঙ্গে।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে দেশজুড়ে পরিচিতি পায় পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথর। ওই বছর পাহাড়ি ঢলে ধলাই নদের উৎসমুখে প্রায় পাঁচ একর জায়গাজুড়ে পাথরের বিশাল স্তূপ জমা হয়, যা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষিত হয়। এরপর আরো কয়েক দফায় পাহাড়ি ঢল নেমে এখানে পাথরের একটি আস্তরণ পড়ে। যদিও দীর্ঘদিন সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে সাদাপাথর ও জাফলংয়ে পাথর লুট ফের শুরু হয়। যার ফলে নিশ্চিহ্নের পথে রোপওয়ে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, আসলে সাদাপাথর ইসিএভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবু আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।
জাফলংয়ে পাথর লুটপাটের বিষয়ে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে লুটপাটের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখন আমরা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি।
স্থানীয়রা জানান, সাদাপাথর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় বিএনপি ও যুবদল নেতারা। বিজিবি ও পুলিশও জড়িত রয়েছে এ সিন্ডিকেটে এমন অভিযোগও করেছেন তারা। এর আগে বিজিবি ও পুলিশের চাঁদা তোলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, আগে নৌকাপ্রতি ১৫০০-২০০০ টাকা চাঁদা তোলা হতো। আর পুলিশকে ম্যানেজ করা হতো আরো ৫০০-১০০০ টাকায়। পরে পাথর উত্তোলনকারীরা প্রতি নৌকা পাথর বিক্রি করত ৫-৬ হাজার টাকায়। এখন সেই সিস্টেমে পরিবর্তন এসেছে। এখন পাথর যে কেউ তুলতে পারে, তবে বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে। অন্যথায় সেই পাথর কেউ কিনবে না। এখন পাথর উত্তোলন চলছে, কেউ বাধাও দিচ্ছে না।
তবে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কারো কারো নাম পাওয়া যাচ্ছে। পাথর লুটপাটে কারো জড়িত থাকার অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কোম্পানীগঞ্জে অতীতে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের বিষয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনও হাতে এসেছে। আমরা অচিরেই ব্যবস্থা নেব।
২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যটন কেন্দ্র জাফলং ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা ইসিএ ঘোষণা হয়।
২০১২ সালে করা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর জাফলং থেকে বালি ও পাথর কোয়ারির ইজারা বন্ধ ছিল। পাথর মজুদের বিষয়টি পরিমাপের মধ্যে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সংরক্ষিত এলাকায় পাথর পর্যবেক্ষণ চলে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুদ ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বেশি পাথর লুট হয়েছে জাফলংয়ে। দাবি করা হয় পটপরিবর্তনের সময়ে প্রায় এক কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়ে যায়। যার বর্তমান বাজারমূল্য শতকোটি টাকারও বেশি। এ সময় পাথরের সঙ্গে বালিও লুট করা হয়।
এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর দুটি মামলাও করেছে। সিলেটের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (পরিবেশ) ২২ জনের বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মামুনুর রশীদ। পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বাদী হয়ে ৯২ জন আসামির নাম উল্লেখ করে অন্য মামলাটি করেন। মামলা দুটি আদালতে চলমান।
মামলা সূত্রে জানা যায়, মামলায় জাফলংয়ের ইসিএ থেকে ১২০ কোটি টাকার পাথর লুটের কথা উল্লেখ করা হয়। গোয়াইনঘাট থানায় দায়ের করা মামলায় আসামিরা হলেন সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক (পদ স্থগিত) রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ, গোয়াইনঘাট উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপনসহ ৯২ জন। আসামিদের মধ্যে অন্তত ৭০ ভাগই বিএনপির সমর্থক।
এ ব্যাপারে বেলা সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, প্রশাসনকে আমি সাদাপাথর রক্ষায় ব্যর্থ বলব না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো যখন চেষ্টা করত। সাদাপাথর রক্ষায় তো তারা কখনো চেষ্টাই করেনি। প্রশাসনের উদাসীনতাই সাদাপাথরের জন্য কাল হয়েছে। অথচ এক বছর আগেও সাদাপাথরে কেউ হাত দেয়ার সাহস পায়নি।
জাফলং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাথর লুটপাটে কারা জড়িত সবাই জানে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কেন কঠোর হয় না সেটাও সবার জানা।
তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, সাদাপাথর রক্ষায় আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই পাথর লুট বন্ধ হচ্ছে না।
আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না প্রশ্ন করলে তিনি একই জবাব দেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।
সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পাথর উত্তোলন প্রাথমিকভাবে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিষয় হলেও তা পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিধ্বংসী পাথর উত্তোলন নদীর পরিবেশের আর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, যা সিলেটের পাথরমহালগুলো দেখলেই স্পষ্ট হয়। সিলেটের পাথরমহালগুলো অপরূপ সৌন্দর্যের আধার। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এ বছরের ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে পাথরমহালগুলো ইজারার বাইরে রেখেছে। কিন্তু থেমে নেই দুর্বৃত্তায়ন ও লুটপাট। এ অপরাধ দমনে নিয়মিত আর সমন্বিত প্রশাসনিক উদ্যোগ অনেক জরুরি। বারবার তাগিদ সত্ত্বেও প্রশাসনিক উদ্যোগে কাঙ্খিত ফল পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে এটাও ঠিক যে প্রশাসনিক উদ্যোগ তখনই জোরদার আর সফল হবে যখন লুটপাট বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকবে। এখানে আমরা উল্টোটা দেখতে পাচ্ছি। বেপরোয়াভাবে পাথর উত্তোলনেই যত আগ্রহ। বাধা দিলেই চলছে আক্রমণ আর ধর্মঘটের হুমকি। পাথর তুলে যা রাজস্ব আসে ধ্বংস আর ক্ষতির বিচার করলে তা যৎসামান্য। পাথর না তুলে ভিয়েতনামের মতো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি রাজস্ব আর কর্মসংস্থান হবে। সরকার সে লক্ষ্যেই সিলেটের পাথর মহালগুলো ইজারার বাইরে রেখেছে এবং একটা পর্যটন পরিকল্পনা করছে।
আপনার মতামত লিখুন :