binodonerpadmaful
ঢাকা সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

কোরবানির ঈদে দাঁতের যত্নে বিশেষ সতর্কতা


বিনোদনের পদ্মফুল | ডা. সানজির হাওলাদার মিলভা জুন ৫, ২০২৫, ০৭:০২ পিএম কোরবানির ঈদে দাঁতের যত্নে বিশেষ সতর্কতা

ঈদুল আজহা তো চলেই এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের মতো দিনটি উৎসবমুখরভাবে উদ্যাপন করার জন্য কমবেশি সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঈদুল আজহার সময় পশু কোরবানির ফলে কমবেশি সবারই ঘরে মাংস থাকে। টাটকা মাংসের স্বাদ পেতে বেশ ক’দিন মেন্যুতে মাংসের তৈরি খাবার প্রাধান্য পায় বেশি। আর তা খেতে গিয়ে মুখ বা দাঁতের দুর্ঘটনা ঘটানো রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যায় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। কারণ ঈদ ও পরবর্তী কয়েক দিন দাঁত মুখের ওপর চলে অন্যরকম এক ‘অত্যাচার’। তাই আজ ঈদ পরবর্তী পরিচিত কিছু দাঁতের সমস্যা নিয়ে কথা থাকছে।
দাঁত ভাঙা বা ব্যথা
মজা করে মাংস খেতে খেতে হঠাৎ হাড়ে কামড় লেগে দাঁতে চিড়/ফাটল ধরা, ভেঙে যাওয়ার ঘটনা কুরবানির মৌসুমে অহরহই ঘটতে দেখা যায়। যাদের দাঁত আগে থেকেই গর্ত হয়ে আছে বা আংশিক ভেঙে আছে, অবহেলা করে চিকিৎসা নেওয়া হয়নি, এমন দাঁত ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। দাঁতে এমন গর্ত, বড় ফিলিং বা দুই দাঁতের সংযোগপৃষ্ঠে ফিলিং, রুট ক্যানেল শেষে ক্যাপ না করা, গঠনগত দুর্বল দাঁত, নকল দাঁত ইত্যাদিতে শক্ত হাড়ের কামড় পড়লে ভেঙে যেতে পারে। এর ফলে সৃষ্ট অমসৃণ অংশে ঘষা লেগে জিহ্বা বা চোয়ালে ক্ষত হতে পারে। অন্যদিকে ভেতরকার মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথাসহ নানা সমস্যার তৈরি হয়। ভেঙে যাওয়া পরবর্তী যন্ত্রণা কেমন তীব্র হবে, তা নির্ভর করে কতখানি ভেঙেছে, তার ওপর।খাওয়ার সময় মনোযোগ থাকতে হবে খাবারের দিকে। এ সময় গল্পগুজব বা টিভি দেখায় মশগুল থাকলে হঠাৎ অসতর্কভাবে কামড় লেগেই এ ধরণের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তাই খাবার খাওয়ার সময় অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
করণীয়: বড় গর্ত থাকলে অবস্থা বুঝে ফিলিং বা রুট ক্যানেল করিয়ে নিতে হবে। মাড়ির দাঁতে রুট ক্যানেল চিকিৎসা শেষে ক্যাপ লাগিয়ে নেওয়া জরুরি। বড় ফিলিং বিশেষ করে সংযোগ স্থানে ফিলিং থাকলে সে দাঁত দিয়ে হাড় না খাওয়া ভালো। মাংসের হাড় যাঁদের প্রিয়, চিকিৎসকের পরামর্শে দাঁত ও মাড়ির অবস্থা জেনে নেওয়া তাঁদের জন্য নিরাপদ। ঈদের সময়কার চিনির তৈরি বাহারি খাবারও দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। দাঁত ভেঙে গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দাঁতে কোনও সমস্যা থাকলে যত দ্রুত সম্ভব রেজিস্টার্ড (বিডিএস) ডেন্টাল সার্জনের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া উচিত। অবহেলার ফল কখনওই ভাল হয় না।
দাঁত পরিষ্কার না করা
যারা বছরের পর বছর ডেন্টাল চেকআপ করাচ্ছেন না, দাঁত ও মাড়ির মধ্যস্থলে প্রচুর পধষপঁষঁং (পাথর) জমে ঢ়বৎরড়ফড়হঃরঃরং হয়ে গেছে, তাঁদের জেনে রাখা ভাল- এই দীর্ঘদিনের অযত্নে দাঁত কিন্তু অনেকটা সাপোর্ট হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে! ইদ উল আজহার সময়টায় দাঁতের ওপর বাড়তি চাপ পড়ায় এই দাঁতগুলো নড়বড়ে হয়ে এমনকি পড়ে যাওয়ারও ঝুঁকি থাকে! এভাবে দাঁত হারানো মোটেও সুখকর নয়। দন্তহীন থাকারও আলাদা জটিলতা রয়েছে।
করণীয়: ৬ মাস বা অন্তত ১২ মাস পর পর রেজিস্টার্ড (বিডিএস) ডেন্টাল সার্জনের কাছে চেকআপ করানো উচিত। বছরে একবার হলেও দাঁত পরিষ্কার করা এতে দাঁত পরিষ্কার ও থাকে আবার দাঁতের যে কোনও সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা নিয়ে সময় ও খরচ- উভয়েরই সাশ্রয় করা যায়। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে কষ্ট পেয়ে শেষ পর্যন্ত অকালে দাঁত হারানোর মত করুণ পরিণতি বরণ করতে হয় না।
দাঁতের ফাঁকে খাবার জমা
বয়স বাড়ার সঙ্গে বা অন্য কোনো কারণে দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্বাভাবিক দূরত্ব বা ফাঁক বেড়ে যায় আর সেই ফাঁকে খাবার জমতে পারে। ঈদের সময় অতিরিক্ত মাংসজাতীয় খাবার গ্রহণের কারণে মাংসের আঁশ সহজেই এখানে ঢুকে পড়ে।আকাবাঁকা দাঁত, ক্ষয় হওয়া বা ভাঙা দাঁতের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটতে দেখা যায়। এটি অস্বস্তিকর তো বটেই, কোনওক্রমে যদি মাংসের আঁশ মুখের ভেতর অলক্ষ্যে থেকে যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বস্তি বা মৃদু ব্যথা কমাতে টুথপিক, কাঠি বা হাতের কাছে যা থাকে, সেটা দিয়েই পরিষ্কারের চেষ্টা করেন অনেকে তাতে জীবাণুর আক্রমণ বেরে গিয়ে দাঁত ও মাড়ির বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হতে পারে! এর ফলে মাড়িতে প্রদাহ ও সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, দুই দাঁতের মধ্যবর্তী ফাঁকা বেড়ে যায়, ফিলিং বা ক্যাপ খুলে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়, দাঁতের ধারক কলা বা পেরিওডন্টাল রোগের সৃষ্টি করে, একপর্যায়ে মাড়ি ফুলে যাওয়া, রক্ত পড়া, ব্যথা, দুর্গন্ধ, দাঁত শিরশির, কামড়ে ব্যথা, নড়ে যাওয়াসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মুখের যত্নে অবহেলা, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকা, ধূমপান প্রভৃতি কারণে টুথপিক বা কাঠি ব্যবহারে জটিলতা তীব্র হয়। কেউ আবার টুথব্রাশ দিয়ে জোরে জোরে ব্রাশ করে খাবার বের করার চেষ্টা করেন, যা থেকে দাঁত ও মাড়ি উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সাধারণ টুথব্রাশের ব্রিসল দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থান পরিষ্কার করতে পারে না, টুথব্রাশ কেবল দাঁতের ৭০ শতাংশের মতো পরিষ্কার করতে পারে।
করণীয়: দাঁতের ফাঁক পরিষ্কারের সঠিক মাধ্যম হলো ডেন্টাল ফ্লস নামের বিশেষ সুতা বা ইন্টার ডেন্টাল ব্রাশ। খাবার জমার প্রবণতা থাকলে ঈদের আগেই এটা জোগাড় করে নিতে হবে, ব্যবহারবিধি না জানলে মনগড়া পদ্ধতিতে না গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ যেমন ১ শতাংশ পোভিডন আয়োডিন, ক্লোরহেক্সিডিন বা উষ্ণ পানিতে লবণ মিশিয়ে খাবারের পর কুলকুচি করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। আক্কেলদাঁতের জটিলতাও বাড়তে পারে এই সময়। এই দাঁত সম্পূর্ণ না উঠলে বা বাঁকা হয়ে উঠলে দাঁতের চারপাশের মাড়ির মধ্যে গৃহীত খাদ্য বিশেষ করে মাংস ঢুকে কষ্টদায়ক প্রদাহের সৃষ্টি করতে পারে। নরম ছোট ব্রাশ দিয়ে মাংস খাওয়ার পর স্থানটি পরিষ্কার করতে হবে।
তবে আগে থেকেই যাঁরা মাড়ির রোগে ভুগছেন তাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি, অন্য দিকে দুই দাঁতের সংযোগ স্থানে গর্ত বা অস্বাভাবিক ফাঁকা থাকলে সেখানেও চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে দাঁতের ত্রুটির কারণে বারবার খাবার আটকালে চিকিৎসার মাধ্যমে ত্রুটি সারানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
চোয়ালে ব্যথা
অধিক পরিমাণে শক্ত হাড়, মাংস চিবানোর ফলে ঃবসঢ়ড়ৎড়সধহফরনঁষধৎ লড়রহঃ (নিচের চোয়ালের সাথে কানের সংযোগস্থল) এ ব্যথা এবং চোয়ালের ফরংঢ়ষধপবসবহঃ ও ঘটতে পারে, তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
করণীয়: ধীরস্থিরভাবে পরিমিত পরিমাণ খাবার খাওয়া, খাবারের একটি বড় টুকরোর বদলে ছোট কয়েকটি টুকরো বেছে নেওয়া ঞগঔ এর ওপর চাপ কিছুটা কমাতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া
এই সময়টায় অনেকে শখ করে চর্বিজাতীয় খাবার একটু বেশিই খেয়ে ফেলেন, যা খাওয়ার পর মুখের ভেতর চর্বি লেগে থেকে একটা চিটচিটে অস্বস্তি ভাব অনুভূত হয়। এটা দাঁত ও মাড়ির জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। তেল-চর্বি, মশলাসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পর অনেকেই কার্বোনেটেড কোমল পানীয়ের গ্লাস হাতে তুলে নেন। এতে থাকা অ্যাসিড এবং মাত্রাতিরিক্ত চিনি দাঁত সহ সারা শরীরের কী পরিমাণ ক্ষতি করে।
করণীয়: লেবু, আদা, আপেল, লেটুস এগুলো মুখের এই চিটচিটে অস্বস্তি ভাব কাটিয়ে মুখগহ্বর ফ্রেশ রাখতে সাহায্য করবে। সাথে অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি তো পান করতেই হবে। কোমল পানীয়ের বদলে বরং হার্বাল চা, ফলের রস, জিরা পানি, গ্রিন টি বেছে নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু উৎসবের সময় তাই কোমল পানীয় যদি পান করতেই হয়, সেটা পরিমাণে যেন খুবই সামান্য হয়। যে কোন খাবার খাওয়ার কিছু সময় পর মুখ ভালমত কুলকুচি করে ফেলা ভাল।উৎসব উদযাপনের আনন্দে সুস্বাস্থ্যের কথা কোনওভাবেই যেন ভুলে না যাই আমরা।
সাধারণ সতর্কতা
খাবার বলতে হলে আপনার দাঁত ও মুখের সুস্বাস্থ্য থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। নয়তো ঈদ–পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কষ্ট পেতে পারেন। তাই দরকার হলে ঈদের আগেই দন্তচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। ঈদে অতিরিক্ত মিষ্টি, অতিরিক্ত শক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই ভালো। মাংস খান কিন্তু পরিমিত পরিমাণ। মাংসের সঙ্গে সালাদ, সবজি ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারও খেতে ভুলবেন না। খাবার খেতে গিয়ে মুখে কী কী সমস্যা বা দুর্ঘটনা হতে পারে, তা আমরা জেনে গেলাম। আশা করা যায়, বিষয়গুলো মাথায় রেখে একটু সচেতন হলে এসব দুর্ঘটনা ঘটে আমাদের ইদের আনন্দে কোনও বিঘ্ন ঘটাবে না। 
সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ্য থাকবেন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। “ঈদের আনন্দ হোক সবার, হাসি ফুটুক প্রতিটি মুখে  সুস্থ এবং সুন্দর দাঁতের সাথে”।

Side banner