binodonerpadmaful
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৫, ২১ আশ্বিন ১৪৩২

রোমান্টিক কমেডি: এই সংশয়াচ্ছন্ন পৃথিবীতে কেন রমকম এখনো জরুরি


বিনোদনের পদ্মফুল | তাসমিহ বিনতে মুশফিক অক্টোবর ৬, ২০২৫, ১০:০৪ পিএম রোমান্টিক কমেডি: এই সংশয়াচ্ছন্ন পৃথিবীতে কেন রমকম এখনো জরুরি

২০২৫ সালে এমন একটি দিনও কাটে না যেদিন আমরা নানা অপরাধ, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ধস, পরিবেশ ব্যবস্থার পতন, দারিদ্র্য, সহিংসতা, বেকারত্ব বা সরকার সংক্রান্ত সংকটের খবর শুনি না। পৃথিবী এখন আগের চেয়ে অনেক জটিল কিছু অর্থে নিজেরই এক খোলস মাত্র। যেমনটি বলে এ এক dog eat dog world, যেখানে দুর্বলতাকে দুর্বলতা হিসেবেই দেখা হয়, মানবিকতা নয়।
এমন বাস্তবতায় কেউ যদি বলে, “আমি How to Lose a Guy in 10 Days পছন্দ করি” তখন অনেকে হয়তো হেসে উঠবে, বিশেষত যখন বাজারে রয়েছে ডেভিড ফিঞ্চারের Fight Club বা ডেভিড লিঞ্চের Mulholland Drive (তাদের কাউকেই অসম্মান করার উদ্দেশ্য নয়; বরং এঁরা আমার প্রিয় পরিচালকদের মধ্যে দুজন)।
মানুষ সাধারণত যেভাবে সিনেমাকে মূল্যায়ন করে, তা প্রায়ই তাদের পৃথিবী দেখার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। কিন্তু বাস্তবে রোমান্টিক কমেডিকে তুচ্ছ ভাবার প্রবণতার পেছনে আছে কেবল রুচির প্রশ্ন নয় বরং গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে নারীবিদ্বেষ, পূর্বধারণা ও নৈরাশ্যবাদ। রমকমকে অবজ্ঞা করার এই মনোভাব নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরে রোমান্টিক কমেডিকে “সহজ, হালকা এবং কেবল নারীদের জন্য তৈরি” বলে ভাবা হয়েছে। অনেকেই পরোক্ষভাবে মেনে নেয় যে রমকম পুরুষালি মানসিকতার সঙ্গে যায় না, বরং তাকে হুমকির মুখে ফেলে। এই ধারণা থেকেও অনেকে ভাবে-রমকম এমন এক ঘরানা যেখানে দর্শকের বেশি ভাবতে হয় না, কোনো জটিল কাহিনি বোঝার দায়ও নেই। অথচ উপেক্ষিত সত্য হলো-রমকম সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম মূল্যবান ঘরানা।
রমকম আসলে মনোমুগ্ধকর গল্প বলার এক শিল্প যেখানে মানবিকতা ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রেখে দর্শককে এমনভাবে টেনে নেওয়া হয় যে সে নিশ্চিন্তে বসে উপভোগ করতে পারে। কারণ রমকমের উদ্দেশ্যই সেটি দর্শককে কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে দেওয়া।
এবার আরও গভীরে দেখা যাক।
মানুষ কাকে “গুরুতর শিল্প” আর কাকে “স্রেফ বিনোদন” বলে মনে করে তা অনেকাংশে তাদের পৃথিবী দেখা ও সংস্কৃতিগত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৯ সালে ডেভিড ফিঞ্চারের Fight Club ছিল ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র। ছবিটি দর্শকের বাস্তবতা-বোধকে নাড়িয়ে দেয়; অস্তিত্ববাদ, নৈরাশ্যবাদ ও ভোক্তাবাদের মতো বিষয়গুলোকে সূক্ষ্মভাবে অনুসন্ধান করে। ছবিটি দর্শককে প্রশ্ন করতে শেখায় আমরা কি আমাদের মালিকানাধীন জিনিসের মধ্যেই সংজ্ঞায়িত? আমরা কি নিজস্ব সমাজেরই পরিত্যক্ত সদস্য?
তবে অনেক দর্শক ভুল করে এটিকে “পুরুষত্ব” বা “আত্মমর্যাদার” গল্প হিসেবে ধরে নেয়। আজকের এই জটিল, বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে অনেকে বিশ্বাস করে অন্ধকার, অনিশ্চয়তা ও কঠোর বাস্তবতাই সত্য ও শিল্পের চূড়ান্ত রূপ। ফলে, যেখানে রমকমের জগতে জীবনের কদর্যতা, জটিলতা ও কষ্ট সবশেষে সুন্দরভাবে মিটে যায়, সেটি অনেকের কাছে বাস্তবতার তুলনায় “অতি সরল” মনে হয়। এই কারণেই রমকমকে অনেকে কম শিল্পসম্মত বা “হালকা” বিনোদন হিসেবে গণ্য করে।
কিন্তু আসল সত্য হলো রমকম তৈরি করা সহজ নয়। এদের ভিত্তি হয় সংলাপের সৌন্দর্য, সংস্কৃতিগত তাৎপর্য, গভীর মানবিকতা ও মমতায়, যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ করে তোলে। রমকমকে ভালোবাসা, শিল্প, আনন্দ, রসায়ন, কষ্ট ও আশাবাদের সারমর্ম ধারণ করতে হয়। রমকম বাস্তবতা থেকে পলায়ন নয়—বরং মানবতার গভীরে লুকানো ভালোবাসা ও সুখের আকাঙ্খার প্রতিবিম্ব।
ক্রিস্টোফার নোলানের Interstellar চলচ্চিত্রে ড. ব্র্যান্ড বলেছিলেন “ভালোবাসাই একমাত্র জিনিস যা সময় ও স্থানের সীমা অতিক্রম করে।”
রমকম আমাদের দিয়েছে অড্রি হেপবার্ন, মেগ রায়ান, গ্রেস কেলি, জন কুসাক, কেট হাডসন, রায়ান গসলিং, হিথ লেজার, জোসেফ গর্ডন-লেভিট, ম্যাথিউ ম্যাককনাহে, এমা স্টোন, জুলিয়া রবার্টস, হিউ গ্রান্ট-এরকম অসংখ্য শিল্পীর দুর্দান্ত অভিনয়।
জন কুসাকের “Say Anything”-এ বুমবক্স উঁচিয়ে ধরা দৃশ্য,
প্যাট্রিক ভেরোনার “10 Things I Hate About You-তে “Cant Take My Eyes Off You গাওয়া, “When Harry Met Sally”-এর বিখ্যাত স্বীকারোক্তির দৃশ্য,
বা Amélie-এর কোমল, ছোট ছোট মানবিক সুখের মুহূর্তগুলো-সবই আমাদের মনে হাসি, উত্তেজনা, আনন্দ ও ভালো লাগার সঞ্চার করে।
রমকমকে অবজ্ঞা করা মানে শিল্পকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা।
রমকমও অন্য যেকোনো ঘরানার মতোই শিল্পসমৃদ্ধ ও গভীর। একে তুচ্ছ ভাবলে সিনেমা হারাবে তার অন্যতম সমৃদ্ধ অধ্যায়।
পৃথিবী হয়তো দিনকে দিন আরও সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠছে, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের সুখ ও ভালোবাসার আকাঙ্খা কখনোই বদলাবে না। এখনই সময়-রমকমকে “সহজ বিনোদন”, “নারীদের সিনেমা” বা “পুরুষত্বের হুমকি” বলে অবহেলা না করে, সেটিকে তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার।
যে কেউ যদি “Clueless” ভালোবাসে “Blade Runner”-এর চেয়ে, তবে সেটিও সমান বৈধ এক রুচি-এখন সময় এসেছে সেই ভুল ধারণা ভাঙার।
তাসমিহ বিনতে মুশফিক
শহীদ বীর উত্তম লে; আনোয়ার গার্লস কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। 

Side banner